খোয়াবনামা-Khoabnama বইয়ের রিভিউ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। নামটা বলতে গেলেই একটি কথা চলে আসে, তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একজন আন্ডাররেটেড লেখক। জনসাধারণের কাছে নামটা খুব একটা পরিচিত নয়। তিনি সমগ্র জীবনে গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন খুব অল্প সংখ্যক, তবে যতগুলো লিখেছেন তার সবগুলোই মাস্টারপিস। 'খোয়াবনামা' আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর দ্বিতীয় এবং শেষ উপন্যাস। আমার এই রিভিউতে কিছুটা স্পয়লার থাকবে, তবে যারা এখনও বইটি পড়েন নি তাদের তেমন কোনো সমস্যা হবে না।

 

বইয়ের নামখোয়াবনামা

'খোয়াবনামা' কিংবা 'খাবনামা' শব্দটির সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত, যা দ্বারা স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদান করা সম্পর্কিত নিয়মকানুন বুঝিয়ে থাকে। এই উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট একটি খোয়াবনামার বই ও খোয়াব ব্যাখ্যাকারী নিয়ে হলেও উঠে এসেছে গ্রামের ভালো-মন্দ নানাবিধ কাহিনী। ব্রিটিশ শাসন তখন শেষ হতে চলেছে। বাংলাদেশের কোনো এক প্রত্যন্ত এলাকায় একটি বিল, নাম কাৎলাহার বিল। বিলের দুই প্রান্তে দুটি গ্রাম, গিরিরডাঙ্গা আর নিজগিরিরডাঙ্গা। গ্রামে আছে চাষী গোষ্ঠী আর জেলে গোষ্ঠী, মুসলমান গোষ্ঠী আর হিন্দু গোষ্ঠী। এসব গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে ছিল দা-কুমড়া সম্পর্ক। আবার মুসলমানদের মধ্যে ছিল সুন্নী ও আহলে হাদিস দুই গ্রুপ, এদের মধ্যে ছিল আকিদাগত দ্বন্দ্ব। হিন্দুদেরও নিজেদের মধ্যে ছিল বংশীয় দ্বন্দ্ব। বহুকাল আগে একবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিপাহির হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মুনসী বায়তুল্লা শাহ। সেই থেকে কাৎলাহার বিলের দুই প্রান্তের মানুষ জেনে আসছেন বিলের উত্তরে পাকুড়গাছে আসন নিয়ে বিল শাসন করেন মুনসীর অশরীরী আত্মা। এক সময় বিলের মালিকানা চলে যায় জমিদারের হাতে। শুরু হয় জেলেদের উপর নানা অবিচার, আর তারই প্রেক্ষাপটে শুরু হয় নানা আন্দোলন। ওইদিকে সুনসীর শোলোক দিয়ে গান গেয়ে আর স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে বেড়ায় চেরাগ আলী ফকির। চেরাগ আলী ফকির তার একমাত্র নাতনী কুলসুমকে বিয়ে দেন বিপত্নীক তমিজের বাপের সাথে। এরই মধ্যে হঠাৎ উধাও হন চেরাগ আলী ফকির। সকলে বলেন তিনি নাকি মারা গেছেন। চেরাগ আলীর সঙ্গ পাওয়ার পর তমিজের বাপ শুরু করে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখা। গভীর রাতে ঘুমন্ত অবস্থায়ই মুনসীর খোঁজে চলে যান বিলের উত্তরে সেই পকুড়গাছের নিকট, আবার ফিরে আসেন ঘুমন্ত অবস্থায়ই। তমিজ দেখে জমির স্বপ্ন, ফসলের স্বপ্ন, আর ফুলজানের ভালোবাসার স্বপ্ন। তবে সে স্বপ্ন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নয়, জেগে জেগে দেখা স্বপ্ন। তমিজের বাপের স্বপ্ন, তিনি একদিন দেখা পাবেন মুনসীর। 

মাঝিদের নেতা কালাম মাঝি আর তার ছেলে তহসেনের স্বপ্ন জেলেদের উপর কর্তৃত্ব নেয়া। জমিদার শরাফত মন্ডল স্বপ্ন দেখে চাষাদের উপর নিয়ন্ত্রণ নেয়া। আর মন্ডলের ছোট ছেলে আব্দুর কাদের পরিচালনা করে মুসলিম লীগের রাজনীতি, স্বপ্ন দেখে পাকিস্তানের জয় হবে, কায়েম হবে মুসলিম শাসন। ফুলজানের আগের স্বামী কেরামত আলীর স্বপ্ন চেরাগ আলীর রেখে যাওয়া খোয়াবনামার বই হাতে পাওয়া। গিরি বংশের উত্তরাধিকারী বৈকুন্ঠ গিরি স্বপ্ন দেখে বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া ভবানী পাঠক ফিরে আসবে, আবার শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে গ্রামে। সমাজের এমন এক প্রেক্ষাপটে শুরু হয় উপন্যাসের কাহিনী। উপন্যাসটির শুরুটা হয়েছে মূলত একটু অন্যভাবে, মানে প্রথমে ঘটনার সিকুয়েন্স ধরতে একটু বেগ পেতে হবে। এ ধরনের উপন্যাস ব্যাক্তিগতভাবে আমার অনেক প্রিয়। শুরু থেকেই পাঠককে গোলকধাঁধায় ফেলে দেয়। শেষটা বললে হয়ত বইটি পড়ার পূর্বেই অনেক কিছু জেনে যাবেন, তাই আপাতত সে অংশে না আসি। তবে বলে রাখি, শেষটা আপনাকে চরমভাবে ভাবতে বাধ্য করবে।

উপন্যাসটিতে লেখক মাটি ও মানুষের এতটা কাছে পৌছুতে পেরেছেন, আপনার মনে হবে ঘটনাগুলো আপনি যেন সামনাসামনি দেখছেন। উপন্যাসটিতে গ্রামীন সমাজের মানুষদের সম্পর্কে খুব সুন্দরভাবে জানা যায়। উপলব্ধি করা যায় মানুষগুলো তাদের কাজের প্রতি কতটা রেস্পন্সিবল। বিষয়গুলো পাঠকের হৃদয়কে খানিকটা আঘাত করবে। গ্রামের মানুষের কুসংস্কার, হানাহানি-দ্বন্দ, রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতা, অতি মাত্রায় সহজ-সরল জীবন যাপন, জমিদারদের অত্যাচার এবং সবশেষে বাস্তবতার কাছে মানুষ কতটা অসহায় হয়ে দাঁড়ায়, আবার কীভাবে মেনে নেয় সেসব বাস্তবতাকে ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে উপন্যাসটিতে। একটি কাহিনীর মধ্য দিয়ে এতগুলো বিষয় তুলে আনতে পারা নিঃসন্দেহে চমৎকার মেধার পরিচয়।


শেষের কবিতা- Shesher kobita বইয়ের রিভিউ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যারা বইটি পড়বেন, তাদের জন্য কয়েকটি বিষয় বলে রাখা ভালো। বইটি আকারে মোটামুটি বড়। তাই ধৈর্য্য রেখে পড়তে হবে। পাঠকদেরকে গ্রামের মানুষের অতি নিকটে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে লেখক এতটাই বেশি আঞ্চলিক কথা ব্যাবহার করেছেন, আপনি উত্তরবঙ্গের মানুষ না হলে দু-একটি কথা বুঝতে সময় লাগবে। তবে গ্রামের ভাষার সাথে পরিচিত থাকলে আমার মত বিপদে পড়তে হবে না। কিছু কিছু শব্দ আমাদের কাছে খুব বাজে শব্দ হিসেবে পরিগনিত হলেও প্রামের মানুষের কাছে এগুলো স্বাভাবিক কথোপকথন, তাই সেগুলো দেখে কোনোভাবেই লেখককে অশ্লীল বলার সুযোগ নেই। তবে অবশ্যই প্রাপ্তবয়ষ্কদের জন্য সাজেস্ট থাকবে বইটি।

 

বইয়ের নাম: খোয়াবনামা

লেখক: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

ধরন: সামাজিক উপন্যাস

প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ

প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ