অপরাজিত” বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক অনবদ্য সৃষ্টি৷ উপন্যাসটি “পথের পাঁচালী” এর পরবর্তী পর্ব। যারা লেখকের “পথের পাঁচালী” উপন্যাসটি পড়েছেন তারা সকলেই দূর্গা-অপুর নাম শুনে থাকবেন৷ সেই অপুর সদ্য কিশোর থেকে বড় হয়ে ওঠার গল্প স্থান পেয়েছে বইটিতে। বইটিতে লেখক অসাধারণ বর্ণনায় শত প্রতিকূলতার মাঝেও অপুর অপরাজিত থাকার গল্প, জীবন যুদ্ধে হার না মানার গল্প নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন।
কাহিনী সংক্ষেপঃ-
বিভূতিভূষণের প্রথম এবং সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস
“পথের পাঁচালি”তে আমরা যে ছোট্ট অপুকে দেখি,তারই পরিণতির গল্প হলো
“অপরাজিত”।নিশ্চিন্দিপুর নামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে দারিদ্রের কষাঘাতের মধ্যেও
প্রকৃতঘনিষ্ঠ আনন্দময় জীবনে বেড়ে উঠছিলো দুই হরিহর আত্মা-অপু এবং তার বোন
দুর্গা।বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরে পড়ে দুর্গার মৃত্যু হয়।পিতা হরিহর গ্রাম থেকে চলে আসেন
কাশীতে। সেখানে তার মৃত্যু হয়। মাতা সর্বজয়া অপুকে নিয়ে শহরে চলে আসেন।সেখান থেকেই
এ উপন্যাসের সূচনা।এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অপু, মিষ্টি চেহারার খামখেয়ালী এক
ছেলে। পড়তে ভালবাসে খুব। লেখাপড়াতেও তার ছাপ ফেলে সে।বহু অভাব-দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও
সে তার লেখাপড়া চালিয়ে গেছে।অদম্য আগ্রহে কলেজের পাঠ শেষ করে সে, কিন্তু বিধি বাম!
বাধা হয়ে আসে দারিদ্র্য-অর্থকষ্ট-অভাব, পুরো উপন্যাস জুড়েই যা তাড়া করেছে
অপুকে।ইতোমধ্যে তার মায়ের মৃত্যু হয়।জঠর জ্বালা মেটাতে কাজের খোঁজে বেড়িয়ে পরে সে।
কখোনো ছেলেমেয়েদের পড়ানো, কখোনো পত্রিকা বিক্রয়,লেখালেখি,লোহালক্কড়ের ব্যবসায় নেমে
খাওয়া-পরার খরচ মেটায় সে।অপুর বোহেমিয়ান জীবনে সুরের ঝংকার নিয়ে আসে, অপর্ণা-তার
সহধর্মিণী। উপন্যাসে অপুর সাথে অপর্নার পরিচয় ও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াটুকু বেশ
নাটকীয়।অপুর শূণ্যজীবনে অপর্ণা যেন আশা ও স্বপ্নের বাতি হিসেবে এসেছিল।আহা! বইটি
না পড়লে তা জানা যাবে না।নিশ্চিন্দিপুরের জীর্ণকুটিরে অশ্রু লুকিয়ে পরম মমতায়
সংসার গুছিয়ে নেয় বাবা-মা’এর অতি আদরের অপর্না। চাঁপাফুলের আকুল করা ঘ্রাণে
অপু-অপর্নার প্রেম,ভালোবাসা,অভিমান,চিঠির জবাব না দিয়ে অপুর ছন্নছাড়া
জীবণ,খুনসুঁটিতে ভরপুর সংসারের চমৎকার চিত্রায়ন পাওয়া যায় উপন্যাসটিতে।বড্ড
টানাপোড়েনের সংসারে, কলকাতার একরুমের কামরায় বিকেলের শেষে অপর্ণার ছোঁয়ায় অপুর
জীবন ভালোবাসার ছাঁদে বাধা পড়ে।তবে অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস,সন্তান জন্মের সময়
অপর্ণার মৃত্যু অপুকে একা করে দেয়।পুত্র কাজলকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধে অপু।অপু যে
অনিন্দ্যসুন্দর পরিবেশ,যে আনন্দ, যে প্রকৃতির সান্নিধ্যে বড় হয়েছে- কলকাতায় তার
ছেলের এসবের অপূর্ণতা অপুকে বড় ভোগায়। তাই সে এক সময় ফিরে আসে শিকড়ে—নিশ্চিন্দিপুরে।
হয়ত বা সেই আগের মত নেই অনেক কিছুই,তবুও সেই শিকড়ে, সেই একই ভাবে বেড়ে উঠতে আরেক
অপু!
ঈষৎ বৃহৎ উপন্যাসটিতে মোটা দাগে যেটা চোখে পরে,
সেটা হল অপুর অসাধারণ জীবনবোধ-তার হার না মানা মনোভাব।মা,স্ত্রী,বন্ধুদের জন্য তার
বুকভরা ভালোবাসা।জীবনের অনেক বাধা পেরিয়েও তার মধ্যে নৈরাশ্য বাসা বাঁধে নি,তার
অনুপ্রেরণা তার আবাল্য সাথী, তার বিস্ময়ের বস্তু-প্রকৃতি।প্রকৃতির বিশালতায় সে
মুগ্ধ হয়েছে, প্রকৃতি থেকে সে অকৃপণ হস্তে আহরণ করেছে তার
জীবন-সঞ্জীবনী,বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে সে আবিষ্কার করেছে প্রকৃতি ও মানব জীবনের
অখণ্ড-অভিন্ন সম্পর্কের চিরায়ত তাৎপর্য,শ্রবণ করতে পেরেছে প্রকৃতির মাঝে আপন
সত্তাকে খুঁজে নেওয়ার আহ্বান। লেখকের
একটি কথা থেকে কিছুটা হলেও সে ধারণা পাওয়া যায়-“সে জন্ম-জন্মান্তরের পথিক-আত্মা,
দূর হইতে কোন সুদূরের নিত্য নূতন পথহীন পথে তার গতি, বিরাট জীবনটা নিউটনের মহাসমুদ্রের মতই
সকলেরই পুরোভাগে অক্ষুণ্ণভাবে বর্তমান নিঃসীম সময় বাহিয়া সে গতি সারা মানবের যুগে যুগে বাধাহীন।” এছাড়া ভালো লেগেছে অপুর জীবনের বড় বড়
দুঃখ আর অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভালোলাগার প্রাপ্তির বর্ণনা। অপুকে মনে হয়েছে আমাদের
নিত্যকার জীবনের অতি সাধারণ অতি আপন, অতি পরিচিত কেউ- কিন্তু কোথাও যেন আমাদের
সব্বাইকে ছাড়িয়ে সে মহিমান্বিত জীবনযুদ্ধে অপরাজিত এক রথের সারথি।
ব্যক্তিগত অনুভূতি-
আমি এই বই পড়ে একদম সত্যি বলতে বাকহীন হয়ে
গেছি। একটা বই কিভাবে এতটা সুন্দর হয়? এতটা মায়া হয়? পুরোটা বই পড়তে পড়তে বার বার
আমার চোখ ভিজেছে। সেটা দুঃখে হোক বা আনন্দে। অপুর জীবনের সাথে যেন আমি একদম
চলছিলাম। সে যখন ক্ষুধার কষ্টে কোনমতে ছাতু খেয়ে দিন পার করছিলো, একদিন খেয়ে পরের
দিনের খাবার নেই, তখন আমার মনে হচ্ছিলো, কি হবে এরপর? টাকা আসবে কোথা থেকে? অপু
খাবে কি পরের দিন? থাকবে কোথায়? যখন কোন গ্রামের পথ ধরে সে হেঁটে যায়,সে যা চিন্তা
করছে, আমি যেন স্পষ্ট সেসব দেখতে পারছিলাম। নিশ্চিন্দিপুরের সেই ভিটায় যখন সে আবার
পা দেয়, প্রতিটা বর্ণনা আমি নিজ চোখে দেখছিলাম। অপুর স্মৃতিচারণে আমার কান্না
পাচ্ছিলো। কতটা কষ্ট, কত আনন্দ, দুঃখের স্মৃতি নিয়ে সে তার বাবা মায়ের ভিটায় পা
দিয়েছিলো। আমি বোধহয় বলেও বোঝাতে পারবোনা আমার অনুভূতি। আমি যদি পারতাম এই বইটাকে
হাজার হাজার তারা দিতাম। কোন কোন বিষয়ে পথের পাঁচালীর চেয়ে অনেক অনেক সুন্দর এই
অপরাজিত। আপনি এই বই না পড়লে, জীবনে অনেক বড় কিছু বাকি থেকে যাবে। আপনি মন থেকে
জীবনটাকে অন্যভাবে দেখবেন এই বই পড়লে৷
“অপুর
সংসার” সিনেমাটা এত সুন্দর করে তৈরি করেছেন
সত্যজিত রায়। আমি বই পড়ার সময় শুধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে চোখের সামনে দেখছিলাম।
আমি জানিনা, অনেক অনেক কথা বলে ফেলছি। তবে শেষ কথা হলো এই বইটা পড়ুন। না পড়লে
এক্ষণ শুরু করুন। পড়লে আবার পড়ুন।
বইয়ের নাম: অপরাজিত
লেখক: বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়
ধরণ: উপন্যাস
পৃষ্ঠাসংখ্যা:৩০২
মূদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা
প্রকাশকাল:১৯৩২
0 মন্তব্যসমূহ