বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা ১০ উপন্যাসের বই

১.প্রথম আলো- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলি সবই প্রায় বাস্তব ঐতিহাসিক চরিত্র। রবীন্দ্রনাথ আর সমসাময়িক ত্রিপুরার রাজপরিবারের এসব গল্প দিয়ে শুরু হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'প্রথম আলো' উপন্যাসের কাহিনী। দুই খণ্ডের এই উপন্যাসটি প্রায় ১২০০ পৃষ্ঠা জুড়ে বিস্তৃত। উপন্যাসটি লেখকের 'সেই সময়' উপন্যাসের সিকুয়েল। 'সেই সময়' উপন্যাসটি যখন শেষ হচ্ছিল, তখন ১৯০০ সাল আসন্ন। উপন্যাসটির শেষ পত্রে তাই নতুন শতাব্দীতে নতুন আলোর আগমনের আভাস ছিল। 'প্রথম আলো' উপন্যাসটি যেন নতুন শতাব্দীর সেই নতুন আলোকে ধারণ করেই এগিয়েছে।



এ উপন্যাসে ত্রিপুরার রাজপরিবার থেকেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বের করে আনেন 'ভরত' নামক একটি কাল্পনিক চরিত্র। আর ভরতকে কেন্দ্র করেই সন্নিবেশিত হতে থাকে উপন্যাসের প্লট। প্লটের সাথে সাথে জুড়ে দেয়া হয় একেকটি ঐতিহাসিক চরিত্র। ভরত সময়ের প্রতিনিধি হয়ে ঘুরতে থাকে ভারতবর্ষের নানা প্রান্তরে, ইতিহাসের দ্বারে দ্বারে। ভরতের পাশাপাশি উপন্যাসেটির গল্পের সাথে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর সংযোগ তৈরিতে কাজ করেছে ভূমিসুতা নামক আরেকটি নারী চরিত্রও। সময়ের অন্যায্য দাবির সাথে আপোসহীন ভূমিসুতা একসময় নয়নমণি নামে বিখ্যাত হয়ে আবার ভূমিতেই নেমে আসে, আবার ভূমিসূতা হয়ে উঠে। ভরত আর ভূমিসুতাই তাই হয়ে উঠেছে উপন্যাসের প্রধান নায়ক ও নায়িকা।

প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথের কবি হয়ে উঠার পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর ভূমিকা। রবীন্দ্রনাথের সাথে কাদম্বরী দেবীর ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। তিনিই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের কাব্যলক্ষ্মী, তার কবি হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা। তাদের দু'জনের সম্পর্কের ইতিবৃত্ত এবং রবীন্দ্রনাথের বিবাহের অব্যবহিত পরেই কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার ঘটনা 'প্রথম আলো উপন্যাসে' গল্পচ্ছলে অসাধারণ নাটকীয়তায় ফুটে উঠেছে।

উপন্যাসটিতে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কাহিনী, স্ত্রী মৃণালিনীর সাথে তার সম্পর্ককের স্বরূপ। পরিপূর্ণ কবি হয়ে ওঠার পাশাপাশি একজন প্রেমিক, একজন স্বামী, একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা, একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ, সর্বোপরি একজন সমাজসেবক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নানামুখী চরিত্র উপন্যাসটিতে নিখুঁতভাবে অঙ্কিত হয়েছে; অঙ্কিত হয়েছে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার পেছনে কবির শ্রম, ভালোবাসা আর ত্যাগের গল্প। ফুটে উঠেছে সেখানে একজন কবির 'গুরুদেব' হয়ে উঠার প্রেক্ষাপট।


২.দূরবীন- শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়



দূরবীন শুধু দূরকে কাছেই আনে না, উল্টো করে ধরলে কাছের জিনিসকেও দূরে দেখায়। আপনি কিভাবে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো বিষয়কে দেখবেন,সেটিই আপনার পুরো অনুভূতিকে পাল্টে দিতে পারে...

দূরবীন উপন্যাসে সমান্তরালভাবে দুই ভাগে বিংশ শতাব্দীর দুইয়ের দশক থেকে আটের দশক পর্যন্ত বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে তিন প্রজন্মের কাহিনী চমৎকার ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম প্রজন্মের প্রতিভূ হেমকান্ত, শান্তিপ্রিয়, আত্মনির্ভরশীল জমিদার হেমকান্ত। হেমকান্তের মৃত্যুভয় দিয়েই উপন্যাসের সূচনা। বিপত্নীক হেমকান্তের সঙ্গে রয়েছে প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন পুরোহিতকন্যা রঙ্গময়ীর আশ্চর্য ও গোপন প্রণয়, যে প্রণয়ে চাহিদা নেই, চাওয়া পাওয়ার হিসেব নেই, আছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও একে অন্যের মানসিক শক্তি হয়ে থাকার আকাংখা।

দ্বিতীয় প্রজন্মের কান্ডারি কৃষ্ণকান্ত। শিশুকাল থেকেই সে তেজোদ্দীপ্ত, সাহসী ও স্বদেশি আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। প্রচন্ড রকমের দেশ প্রেমিক কৃষ্ণকান্তর ও দেশভাগের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘটে পরিবর্তন।

তৃতীয় প্রজন্মের কর্ণধার ধ্রুব! উপন্যাসের সবচেয়ে রহস্যময় চরিত্র! রহস্যাময় চরিত্র এই জন্য যে, সে এক উদ্ধত,বিদ্রোহী, মাতাল,পাষাণ,খামখেয়ালি চরিত্র অথচ উপন্যাসের যে কোনো এক পর্যায়ে হলেও তার প্রতি কিছুটা দুর্বলতা এসেই যায়! উপন্যাসে এই দুর্বলতার চরম শিকার ধ্রুবর স্ত্রী রেমি। এত অবহেলা! অথচ তাও এত আকর্ষণ তার সুদর্শন ধ্রুবর প্রতি! রেমির মাধ্যমে চিরায়ত বাঙালি নারীর অন্ধ স্বামীভক্তি ফুটে উঠেছে,তবে ব্যক্তিগত ভাবে স্বামীর চরিত্রহীনতাকেও এত সহজে মেনে নেবার জন্য মনে হয়েছে ধ্রুবর নেশায় রেমি তার ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মান বিসর্জন দিতেও কুন্ঠাবোধ করে নি।

পিতৃস্নেহের এক অনন্য দিক উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। পিতাপুত্র হিসেবে হেমকান্ত আর কৃষ্ণকান্তের সম্পর্ক খুব গভীর ছিল না,তবে পুত্রর প্রতি ভালবাসা আর পিতার প্রতি শ্রদ্ধার অন্ত ছিল না। অন্যদিকে পরে পিতা হিসেবে কৃষ্ণকান্ত তার অবাধ্য ছেলে ধ্রুবর প্রতি অশেষ স্নেহ লালন করলেও পুত্রের কাছ থেকে ঘৃণা ও বিদ্বেষ বৈ আর কিছুই লাভ করেন নি এই হতভাগ্য পিতা! জেনারেশন গ্যাপ আর ধ্রুবর গোয়ার্তুমি ই এই পিতা-পুত্রের শীতল যুদ্ধের জন্য দায়ী।

ছোট খাটো আরো অসংখ্য চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে উপন্যাসটিতে। ৬১৬ পৃষ্ঠায় আপনি মন্ত্রমুগ্ধের মত নিশ্চিত মিশে যাবেন সকল চরিত্রে, উপন্যাসের প্রতিটি পাতায়।


৩.শাপ মোচন - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মহেন্দ্র দীনতার জন্য পিতৃ বন্ধু উমেশবাবুর কাছে সাহায্যের জন্য কলকাতায় যায়। উমেশবাবুর বাড়ির সকলে মহেন্দ্রকে সদরে গ্রহণ করে নেয়। একসময় উমেশবাবু ছোট মেয়ে মাধুরী মহেন্দ্রকে ভালোবাসতে শুরু করে।শুরু মাধুরী নয়,মহেন্দ্র ও মাধুরীকে ভালোবাসতে শুরু করে।এই ভালোবাসা যে কতটা গভীর,কতটা সত্যি সেটা উপন্যাসটা না পড়লে বোঝা যায় না।সত্যি মাধুরী অন্যন্য, অন্যতম, অসাধারন।এভাবেও ভালোবাসা যায় সেটা আগে আমি জানতাম না।উপন্যাস টা পড়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম।বারবার মনে হচ্ছিল এটা কেন হলো।কেউ এভাবে ভালোবাসে কিভাবে??


৪.কোথাও কেউ নেই – হুমায়ুন আহমেদ



গল্পের মূল চরিত্র মুনা। বাস্তবিক, স্ট্রং, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, প্রবল আত্মসম্মানবোধ এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বের এক মেয়ে। ছোটবেলায় মা-বাবা হারানো মুনার বেড়ে ওঠা হয় মামার কাছে। ছোটবেলায় বাবা-মামা হারানো, এরপর একে একে না পাওয়ারা মুনাকে বানিয়ে দিয়েছে কাটখোট্টা বাস্তববাদী। মামা-মামী, মামাতো বোন বকুল আর মামাতো ভাই বাবুকে নিয়েই মুনার পরিবার। একটা পর্যায়ে এসে মুনা প্রেমে পড়ে হাসান সাহেবের। সে কী গভীর প্রেম! কথায় আছে না- অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকায়। আজীবন ভালোবাসার কাঙাল মুনার সে ভালোবাসাটুকু জোটেনি, সম্পর্ক ভেঙে যায় হাসান সাহেবের সাথে। উপন্যাসের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বাকের ভাই। যে এলাকাতে ছোটোখাটো গুণ্ডা হিসেবে পরিচিত, জেলেও যাওয়া হয়েছে। মুনার প্রতি যার ভালোলাগা ছিলো অসীম কিন্তু কখনও প্রকাশ করেনি। বিপদে আপদে সবসময় মুনার পাশে থেকেছে। একটা পর্যায়ে এসে মুনা নিজেও ভালোবেসে ফেলে বাকের ভাইকে। কিন্তু তখন বড্ড দেরী হয়ে গেল! বাকের ভাইকে মিথ্যে মামলার জের ধরে নিয়ে গেল। প্রথমে মামী মারা গেল, মামা মারা গেল, বকুলের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর অন্যত্র চলে গেল সাথে বাবুও চলে গেল। আর শেষ যাকে নিয়ে একসাথে থাকার আশা বুনেছিল সে বাকের ভাইও জেলে চলে গেল। এ পৃথিবীতে মুনা হয়ে পড়লো একলা একা, যার কোথাও কেউ নেই।


৫.ন হন্যতে - মৈত্রেয় দেবী



এটি একটি আত্মজীবনী মূলক প্রেমের উপন্যাস। ১৯৩০ সালে মৈত্রী দেবীর বাবা গল্পের নায়ক মির্চা এলিয়াদ কে তাদের বাড়িতে থাকার জন্য নিয়ে আসেন।তখন মির্চা এলিয়াদ এর বয়স ২৩ এবং মৈত্রী দেবীর বয়স ১৬।দুইজনেই ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন দেশের হওয়াতে দুইজন দুইজনের প্রতি ভীষণ কৌতুহলী হয়ে পড়েন।পরে সেটা গভীর প্রেমে পরিনত হয়।কিন্তু এক বছরের মাথায় মৈত্রী দেবীর বাবা বিষয় টা জানতে পারলে মির্চা কে বাড়ি থেকে বের করে দেন।

এর পর ১৯৩৪ সালের দিকে মির্চা এলিয়াদ তার এবং মৈত্রী দেবীর সম্পর্ক নিয়ে,মৈত্রী দেবীদের বাড়িতে কাটানো মুহূর্ত নিয়ে স্মৃতিচারন মূলক বই লেখেন।যেখানে তাদের সম্পর্ক কে অনেক বিকৃত ভাবে উপস্থাপন করেন।

এই ঘটনার বিয়াল্লিশ বছর পর যখন মৈত্রী দেবী জানিতে পারেন তখন তিনি নিজের দিক টা এবং সত্যিটা তুলে ধরার জন্য "ন হন্যতে " লেখেন।


৬.পুতুল নাচের ইতিকথা - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়



হাবু ঘোষের মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে শুরু হয় এই উপন্যাস। এরপর শশীর কলকাতা থেকে গাওদিয়া গ্রামে আসা, গ্রামের মানুষের সাথে মিশে যাওয়া, ডাক্তার হিসেবে পরিচয় লাভ করা, গ্রামের মানুষের চিকিৎসা সেবা করা, অন্যের অনুদানে গ্রামে হাসপাতাল গড়ে তোলা, তার কলেজের বন্ধু কোমরের সাথে মতির প্রেম ও বিয়ের কাহিনী, তাদের ছন্নছাড়া সংসার জীবন, মানুষের কুসংস্কার সম্পন্ন যামিনী কবিরাজের সূর্য বিদ্যার উপর বিশ্বাস, সেন দিদির অসুস্থতা, বাচ্চা প্রসবের সময় সেন দিদির পৃথিবীতে এক করা, কুসুমের সঙ্গে তার ভাব বিনিময় ইত্যাদির বিশ্লেষণধর্মী রুপ পুতুল নাচের ইতিকথা। হাসি-কান্না ,প্রেম-ভালোবাসা ,আবেগ, বিজ্ঞান চিন্তা, কুসংস্কার ,পরোয়া ,উপেক্ষা এসবের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে এ উপন্যাস।পুতুল নাচের ইতিকথা বৃহদায়তন উপন্যাস, মহাকাব্যের মতোই এর জৈবনিক বিস্তার, অসংখ্য মানুষ এবং অসংখ্য মানসিক গঠনের মানুষ এই উপন্যাসে ভিড় করেছে। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ধর্মী উপন্যাস এটি। যদিও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ধর্মী উপন্যাস এটি তবুও এ উপন্যাসে বিভিন্ন কুসংস্কারকে দেখা যায়।মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে মানুষের অবস্থার একটি তীক্ষষ্ট বিশ্নেষণ করেন।ব্যক্তির ভণ্ডামি, জটিলতা ও দুর্বোধ্যতাকে উপস্থাপন করে।


৭.সাতকাহন - সমরেশ মজুমদার



সমরেশ মজুমদারের কালজয়ী উপন্যাস সাতকাহন।"সাতকাহন" নামের মধ্যেই যেন সমস্ত কিছু অন্তর্নিহিত। আর সেই সাতকাহনের প্রাণ ভ্রমরাই দীপাবলি। দীপাবলি নামটা শুনলেই বোঝা যায় অন্যায়, অন্ধকারে বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠা এক উত্তপ্ত আলোকশিখা। উপন্যাসের প্রথমেই দেখানো হয় উত্তর বঙ্গের চা বাগান, কোয়ার্টারের মধ্যে দুরন্ত, চঞ্চল, উড়নচণ্ডী এক ছোট্ট কিশোরী মেয়ের বেড়ে ওঠা। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে আপনার মনে হবে আপনি চা বাগানের রয়েছেন!মাছ ধরতে যাওয়া, ছেলে বন্ধুদের সাথে চড়ে বেড়ানো, শিশির ভেজা শিউলি ফুল কুড়ানো, মায়ের বকুনি, ঠাকুমার আদর, বাবার স্নেহে সবটা নিজে চোখে দেখতে পাচ্ছেন ! উপলব্ধি করতে পারছেন। উপন্যাসটা যে প্রেক্ষাপটে রচিত সেই সময়ে মেয়েরা দীপাবলির মতো ডানপিঠে ছিল না।আর না তাদের সেভাবে চলতে দেয়া হতো।সবে এগারো বছর পর্দাপণ করা সেই ছোট্ট কিশোরীটির বিয়ে হয় মাত্র বাহাত্তর ঘন্টার জন্য। সেই বিয়ের রাতেই সে জানতে পারে তার জীবনের অমোঘ সত্যটি। এতো দিন যাবৎ যাদের বাবা-মা জেনেছে তারা আসলে তার বাবা-মা নয়।আর মাত্র বাহাত্তর ঘন্টা পরই তার জীবনের স্রোতের গতিপথ অন্যদিকে মোড় নেয়। সেই ছোট্ট কিশোরীকে চাপিয়ে দেয়া হয় সমাজের নিষ্ঠুর, নির্মম কিছু বিধি নিষেধাজ্ঞা। সেই সময়ে তার সঠিক পথ প্রদর্শন হয় কখন তার বাবা, কখনো সত্যসাধন মাস্টার আবার কখনো রমলা সেন। সকল বিধি নিষেধাজ্ঞা মেনে জীবন যাপিত করতে করতে দীপাবলি একদিন সব নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে পাঁচ সাবজেক্টে লেটার নিয়ে সে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোলো। তারপর শুরু হলো কলেজ জীবন। তারপরে কলকাতায় পড়াশোনা। শুরু হলো অন্য এক লড়াই। সময়ের পালাক্রমে জীবনে এলো নানান পুরুষ। উন্মোচন হল চেনা মানুষের অচেনা রূপ। তবুও হার না মেনে দীপাবলি এগিয়ে যায় তার আপন লক্ষ্যে। পরিচিত হলো নানান মানুষ।কতশত কাহিনী রচিত হলো । ক্ষমতার অপব্যবহার দেখলো।চা বাগানের সেই ছোট্ট কিশোরীটি আইএ এস‌‌‌ ও দিলো।আয়কর অফিসার হলো।তার জীবনে আবার নতুন পুরুষের আগমন ঘটলো।যার হাত দীপাবলি স্ব-ইচ্ছায় ধরলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি অদেও হাত ধরাছিল?নাকি জীবনযুদ্ধে লড়াকু সৈনিকের জীবন কাটাতে হয় নিঃসঙ্গতা আর একবুক হাহাকার নিয়ে?আর পাঁচটা মেয়ের সাথে কি দীপাবলিকে গুলিয়ে ফেললে চলে? উঁহু সে তো অন্যন্য। দীপাবলির জীবনের শেষ পরিণতি কি হয়েছিল যানতে হলে পড়তে হবে সাতকাহন।


৮. কবি- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়



হিন্দু ধর্ম মতে ডোম বংশে জন্ম নেয়া একটা ছেলে নিতাই চরণের জীবনপ্রবাহ নিয়ে রচিত হয়েছে কবি উপন্যাসটি। নিতাইয়ের বংশের লোকেরা বংশপরম্পরায় ছিলো ডাকাত। তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো লুটপাট করে অন্যের ধন লুটে নেয়া। কিন্তু নিতাই তাদের বংশধরদের পেশা জীবিকা হিসেবে না নিয়ে সে হয়ে উঠে একজন কবি। তাদের গ্রামে চণ্ডীদেবীর পূজা উপলক্ষে মেলা বসে, সে মেলায় কবিয়ালের লড়াই হয়। ঘটনাক্রমে একবার এক কবিয়াল না আসায় সেখানে নিতাই স্থান পায়। আর তার মাধ্যমেই নিতাই কবি উপাধী পেয়ে যায়। সে থেকেই নিতাইয়ের কবি জীবনের শুরু। নিতাই তার বাপদাদার পেশা জীবিকা হিসেবে না নেওয়ায় তাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। নিতাইয়ের পরিচিত এক রেলকর্মকর্তা ছিলো যার নাম রাজা। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিতাই রাজার কাছে আশ্রয় নেয় এবং রেলে কুলি কাজ করে পেট চালাতো। একসময় নিতাইয়ের সাথে পরিচয় হয় রাজার শালির সাথে, যার সাথে ধীরে ধীরে নিতাইয়ের প্রণয় হয়ে যায়। কিন্তু বসন্ত নামে ঝুমুর দলের এক মেয়েকে নিয়ে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে এবং নিতাই তার গ্রাম ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্য পাড়ি দেয়। এরপর নিতাইয়ের জীবনে কি হয়েছিল তা বিস্তারিত জানতে পড়ে ফেলুন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত বিখ্যাত উপন্যাস কবি।


৯.খোয়াবনামা- আখতারুজ্জামান ইলিয়াস


মানুষের আজকের এই এতকিছুর জন্ম কোথা থেকে? আমার বিশ্বাস, ক্ষুধা থেকে। মানুষ প্রথম যে প্রয়োজনীয়তা মেটাতে চায়, সেটা ক্ষুধা। পেটে খাবার থাকলে তখন আসে যৌনতা। আর দুটো বিষয় যদি মোটামুটিভাবেও মিটে যায়, তখন মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। নানা রকমের স্বপ্ন। সুখের স্বপ্ন, সমৃদ্ধির স্বপ্ন। মানুষ যত এগিয়ে যায় তার স্বপ্ন তত বড় হয়। সে যত পায়, পায় খোয়াব তত বদলে যায়। মানুষের সেই খোয়াব নিয়েই ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’।

মানুষের মাঝে বাঙালীরা বোধয় খোয়াব একটু বেশি দেখে। তারা ঘুমিয়ে খোয়াব দেখে, জেগে জেগে খোয়াব দেখে। সেই খোয়াবে মিশে থাকে ইতিহাস, পুরাণ, ঘটে যাওয়া নানা বিষয়। কিছু কথা, উপকথা মানুষকে এতোটা বেঁধে ফেলে যে সে এখান থেকে বের হতে পারে না কখনও। তার খোয়াব ঘুরপাক খায় ওই নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে। তমিজের বাপ এমনই এক লোক।

তমিজের বাপ আবোর, মানে বোকা। তার কেবল খাওয়ার চাহিদা। পেট পুরে ভাত খেতে পারলেই হয়। বাকি আর কিছু চায় না। বুড়ো মানুষটার পাশে যুবতী বৌও তার মাঝে কোন আকাঙ্ক্ষা জাগায় না। তমিজের বাপের খাওয়া মিটে গেলে ঘুমিয়ে থাকে, কিংবা জেগে জেগে খোয়াব দেখে। সে খোয়াব হলো মুনসির খোয়াব। যে নাকি কাৎলাহার বিলের পাশে পাকুড় গাছে উঠে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানেই তার আরশ।

আদতে ইলিয়াস এই তমিজের বাপের মধ্যে এঁকেছেন আবহমান বাংলার এমন কিছু মানুষের কথা, যারা তাদের বিশ্বাসের মধ্যে এতোটা ঢুকে থাকে যে দুনিয়ার বাস্তবতা তাদের কাছে কোন অর্থ বহন করে না। তমিজের বাপ চিনত বিল, বিলের মাছ আর চেরাগ আলী মুনসিকে। সেখানেই সে থেমে ছিল তার বাকিটা সময়। জীবনভর সে ওই নিয়েই থেকে গেছে।

এদিকে বদলে যাওয়া সময়ের স্রোতে ভেসেছে তার উত্তরপুরুষ তমিজ। সে খিয়ারে গেছে ধান কাটতে। মাঝির সন্তান হয়েও এক সময় জমি চাষ করে সে থিতু হওয়ার খোয়াব দেখেছে। সেই সঙ্গে খিয়ারে কাজ করতে গিয়ে সে উদবুদ্ধ হয়েছিল নতুন দিনের চেতনায়। মানুষের অধিকারের আদায়ে তার রক্তের মধ্যে প্রতিবাদ এসে জমেছিল।

কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়েই এখানে ক্ষমতার নানা ব্যবহার চলে। সেই ক্ষমতার প্রতিভু শরাফত মণ্ডল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভূমির মালিকদের দাপট, তাদের ক্ষমতার ব্যবহার এবং মানুষকে দাবিয়ে রাখার প্রবণতা তার মাঝে দেখা যায়।

এরই মাঝে যারা ক্ষেত, বিল, গ্রামের হাট থেকে বেরিয়ে শহরের বাতাস গায়ে লাগায়, তারা বৃহত্তর পরিমণ্ডলের হাওয়া গাঁয়ে ছড়িয়ে দেয়। তখন কারও কারও মনে পাকিস্তান কায়েম করার খোয়াব জাগে। সে খোয়াব সত্য মনে হয় যখন লীগের লোকজন এসে তাদের তাতিয়ে যায়, আশ্বাস দিয়ে যায়। তখন খোয়াব ভেঙে যায় কারও কারও। পুরাতন আনন্দবাজারের খবরে কলকাতায় মুসলমান হত্যার খবরে এখানেও মারা যায় অনেকে। সেখান থেকে ভেঙে যায় আরও খোয়াব।

কিন্তু এসব খোয়াবের সাথে কোন সংযোগ নেই কুলসুমের। কেননা সে জীবনে প্রায় কিছুই দেখেনি। সে দেখেছে তার দাদা চেরাগ আলীকে, দেখেছে তমিজের বাপকে। একজন শোলোক লিখে গেয়ে বেড়াত, অন্যজন সেই শোলোকে কী পেয়েছিল, কুলসুম কোনদিন বোঝেনি। কিন্তু তার সেই দেখা জগতের মাঝেই ঘুরে বেড়াতে থাকে কুলসুম।

ভাঙা গড়া আর মানুষের একান্ত খোয়াবের মধ্য থেকে বৃহত্তরের ব্যঞ্জনা নিয়ে আসা গল্প, ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’। ইলিয়াসকে নিয়ে লেখা সহজ না, সে ধৃষ্টতা করবো না। তবে খোয়াবনামা নিয়ে কিছু বলাই যায়। অনেক কিছু বলেও ফেলেছি। তারপরও কিছু বাকি থাকে। লেখকের এই উপন্যাসের ভাষা তার ‘চিলেকোঠার সেপাই’ থেকে আলাদা। একদম প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের মুখের ভাষায় লেখা এ উপন্যাস।

লেখায় লেখকের সততা বলে একটা ব্যপার আছে। আমাদের আজকের দিনের লেখায় সে জিনিসটা নানা কারণে অনুপস্থিত। সে নিয়ে পরে কখনও বলা যাবে। বিষয়টা একটু বিস্তৃত। তবে ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ পড়লে বোঝা যায় একজন লেখক তার লেখার প্রতি কতটা সৎ হতে পারেন কিংবা ভাবলে অবাক হতে হয় যে কতটা সৎ হলে এমন একটা উপন্যাস লেখা যায়।

ইলিয়াসের লেখায় জাদুবাস্তবতা আছে কিনা, সে নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু ইলিয়াস তার ‘খোয়াবানামা’য় নানা জায়গায় অসাধারণ ঘোর সৃষ্টি করেছেন। কাৎলাহার বিল, পাকুড় গাছ, তার আশপাশ দিয়ে তমিজের বাপের ঘুরে বেড়ানোর বর্ণনায় অবশ্যই ঘোর তৈরি হয়। তেমনি ঘোর তৈরি হয় যখন কালাম মাঝি চড়ে বসে কুলসুমের উপর।

চরিত্র সৃষ্টি এবং চিত্রণে ইলিয়াস অসাধারণ কিছু কাজ করে গেছেন। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে হাড্ডি খিজিরের পর এই উপন্যাসে অবাক করা চরিত্র এই তমিজের বাপ। একটা মানুষ প্রায় কোন কথা না বলে, কোন জায়গায় না থেকে জুড়ে আছে পুরো উপন্যাসে। হাড্ডি খিজির যতটা ‘অ্যাকটিভ’ ছিল, তমিজের বাপ ততটাই ‘প্যাসিভ’। এই থেকে না থাকা বা না থেকেও থাকাটা সবচেয়ে বড় ম্যাজিক ছিল ‘খোয়াবনামা’-র।

শেষটা করবো একটা প্রশ্ন দিয়ে। প্রশ্নটা হলো, ‘মানুষের সবচেয়ে বড় খোয়াব

কী?’


১০.হাজার বছর ধরে- জহির রায়হান



"হাজার বছর ধরে" জহির রায়হান এর একটি কালজয়ী উপন্যাস। আমাদের এই পৃথিবী হাজার বছর ধরে ঘূর্ণায়মান। প্রতিদিন কতশত নতুন মানুষ এই পৃথিবীর আলো বাতাসে স্থান করে নেয় আবার কতশত জন নিয়ম মেনে অতীত হয়ে যায়।

হাজার বছর ধরে এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে রচিত উপন্যাস। উপন্যাসটি সম্পূর্ণ একটি গ্রামীন জীবনকে কেন্দ্র করে রচনা করা হয়েছে। একটি দীঘিকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে সে গ্রাম। উপন্যাসে এই গ্রামের মানুষগুলোর সুখ দুঃখ,হাসি আনন্দ সব মিলিয়ে চিত্রপটের মত এক সোনালী গ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে। টুনি, মন্তু, আম্বিয়া, বুড়ো মকবুল,আমেনা,ফাতেমা, হিরণ প্রত্যেকটি চরিত্র ছিল বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র টুনি আর মন্তু। টুনি বুড়ো মকবুলের তৃতীয়া স্ত্রী হওয়া স্বত্ত্বেও মন্তুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা অনুভব করে। মন্তুর মনের কোনেও আলাদা জায়গা জুড়ে থাকে টুনি। পরীর দিঘিতে রাত বেরাতে শাপলা তুলে, মাছ ধরে আনন্দ খুনসুটিতে কাটে তাদের জীবন।

সুখেই ছিল হাসিখুশি গ্রামটা। কিন্তু নানান সমস্যার বেড়াজালে জীবন পাল্টে যায়। দেখতে দেখতে পাশাপাশি থাকা মানুষগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে হারিয়ে যেতে থাকে। আলাদা হয়ে যায় টুনি আর মন্তু।

জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। সময়ের সাথে সবাই থিতু হয়ে মানিয়ে নেয়। যেভাবে পাঠকরা মেনে নিয়েছে টুনি মন্তুর বিচ্ছেদ। মন্তুর সাথে আম্বিয়ার সংসার। সেই সংসার আলো করে আসা পুত্রসন্তান। আবার সেই আমেজ ফিরে আসে। সেই একই স্থানে পুরোনোদের ভুলে নতুনদের নিয়ে। রাত বাড়ে, হাজার বছরের পুরোনো রাত।

হাজার বছর ধরে উপন্যাসের উপর একটি চলচিত্র নির্মিত হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ